সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় সুন্দরবন সংলগ্ন একটি উপজেলার শ্যামনগর। শ্যামনগর উপজেলার মোট আয়তন ১৯৬৪ বর্গ কিলোমিটার। যার উত্তরে কালিগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলা, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। ১২ টি ইউনিয়ন ও ২১৬ টি গ্রাম নিয়ে শ্যামনগর উপজেলা গঠিত। ইউনিয়ন গুলো হচ্ছে শ্যামনগর , আটুলিয়া, কৈখালী, ঈশ্বরীপুর, কাশিমাড়ী, গাবুরা , রমজাননগর, নুরনগর,পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী,ভুরুলিয়া, মুন্সিগঞ্জ, ।
শ্যামনগর উপজেলার মোট জনসংখ্যা ৩১৩৭৮১ জন।পুরুষ ১৬০২৯৪ জন ও নারী ১৫৩৪৮৭ জন। রমজাননগর ইউনিয়নের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ গ্রাম গোলাখালী, এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও যাতায়াতের চিত্র তুলে আনা হয়েছে। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে শ্যামনগর উপজেলা উপকূল সুন্দরবন লাগোয়া। শ্যামনগর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে বংশীপুর বাস স্ট্যান্ড ।
সেখান থেকে দুইটি রাস্তা দুই দিকে চলে গেছে , একটি মুন্সিগঞ্জ বাজার অন্যটি ভেটখালী বাজার। গোলাখালী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের যাতায়াতের দুইটি প্রধান রাস্তা। ভেটখালী বাজার থেকে রায় নগর পুলিশ ফাঁড়ীর পাশ দিয়ে কোষ্টাগার্ড অফিস পর্যন্ত ২ কিলোমিটার পিচের রাস্তা রয়েছে। সেখান থেকে পাউবো/ রোড দিয়ে ৬ কিলোমিটার ইটের রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। একই রাস্তা ৩ কিলোমিটার মাটির পথ দিয়ে হেঁটে গোলাখালী খেয়া ঘাটে পৌঁছানো যায়। সড়কপথে শ্যামনগর থেকে বাস, ভ্যান, ইজি বাইক, মটর ভ্যান, মোটর সাইকেল যোগে মানুষ যাতায়াত করে। নদী পথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অধিবৃষ্টিপাতের কারণে কাদাযুক্ত রাস্তা সহ ইটের সোলিং রাস্তায় সাধারণ মানুষের চলাচল দুর্বিসহ হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে বিকল্প যাতায়াতের জন্য নদীপথে মানুষের যাতায়াত করতে হয়। ভেটখালী বাজার থেকে ইঞ্জিন চালিত ট্রলার যোগে প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে মাদার নদীর বুক দিয়ে গোলাখালি পাঁচ নদীর মোহনা দ্বীপ গোলাখালি গ্রামে যাওয়া যায়। মুন্সিগঞ্জ বাজার থেকে পূর্ব দিকে বিশ্বরোড পিচের রাস্তা দিয়ে প্রথমে পড়বে হরিনগর বাজার প্রায় ৮ কিলোমিটার। হরিনগর বাজার থেকে আবারও পূর্ব দিকে সুন্দরবন বাজার হয়ে পারশেমারী ব্রীজ ৯ কিলোমিটার পিচের রাস্তা পর্যন্ত, সেখানে
একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা, ভ্যান, ইজি বাইক, মটর ভ্যান, মোটর সাইকেল যোগে মানুষ যাতায়াত করে। পারশেমারী ব্রীজ থেকে বাম দিকের টেংরাখালী বাজার ১ কিলোমিটার জরা জীর্ন ইটের রাস্তা রয়েছে,ঝুকি এড়াতে পায়ে হাটাই শ্রেয়,এই রাস্তা দিয়ে ভ্যান, মোটর সাইকেল যোগে মানুষ যাতায়াত করছে। টেংরাখালী বাজার থেকে দুর্বিসহ যাত্রা ৪ কিলোমিটার পানি উন্নয়ন বোর্ডে বেড়িবাঁধের রাস্তা শুষ্ক মৌসুমে মোটর সাইকেল যোগে মানুষ যাতায়াত করতে পারে। তাছাড়া অধিকাংশ সময়ে পায়ে হেঁটে গোলাখালী পৌঁছাতে হয়। নদী পথে ভারী বর্ষণ ও দুর্যোগ কালীন সময়ে মুন্সীগঞ্জ বাজার থেকে ট্রলার যোগে মালঞ্চ নদী দিয়ে দক্ষিণ কদমতলা দিয়ে প্রথমে পড়বে হরিনগর বাজার, সেখান থেকে চুনকুড়ী নদী দিয়ে একই ট্রলার দিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা ট্রলার ভ্রমণের পরে গোলাখালী যাওয়া যায়। ১৯৮৮ সালে গোলাখালী বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষের খেয়া পারা পার করে আসছেন ফিরোজা বেগম, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছে শরীর তবুও খেয়া দিয়ে সংসার চালাতে হয়। ঝড় জল্লোচ্ছাস নদী ভাঙ্গনে বিরাম নেই ফিরোজা বেগমের।
আমরা পার হয়েছি ফিরোজার তরীতে, গিয়েছি গোলাখালী দ্বীপে। সেখানে পায়ে হেঁটে চলতে হয় এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত।খেয়া পার হয়ে প্রথমে গোলাখালি দক্ষিণপাড়া, দক্ষিণ পাড়াটি সুন্দরবনের সাথে লাগোয়া, দেখলে মনে হয় সুন্দরবনের বাঘে মানুষের বসবাস। এরপর হাফ কিলোমিটার রিং বাঁধ উপর দিয়ে হেঁটে গোলাখালী মাঝপাড়া। দুজন মানুষ এক সঙ্গে হেঁটে যেতে পারবে না। গোলাখালীর মাঝ পাড়ায় রিং বাঁধ দিয়ে সেভ করা মনে হলেও মাঝে মাঝে জোয়ারে ভাসে আবার ভাটায় জেগে ওঠে জানান স্থানীয়রা। গোলাখালীর মাঝপাড়া থেকে উত্তর পাড়া প্রায় হাফ কিলোমিটার। এই যাতায়াত পথ দু-বার পরিবর্তন করা হয়েছে।
গোলাখালীর উত্তর পাড়ায় ১৭টি পরিবার ৩বছর ধরে জোয়ার ভাটার সাথে দিন কাটাচ্ছে।মাঝ পাড়ার সাথে উত্তর পাড়ার সংযোগ রাস্তা জোয়ারে ডুবে যায়, আবার ভাটায় জেগে ওঠে। ভাটায় চলাচল করে উত্তর পাড়ার মানুষেরা। রমজাননগর ইউনিয়নের ৭নংওয়ার্ডের গ্রাম পুলিশ গোপাল মুন্ডা বলেন গোলাখালী দ্বীপে ৮৭টি পরিবার আছে। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ সহ সুন্দরবনের বাঘের গর্জন ও আক্রমণের কারণে মানুষ গ্রাম ছাড়তে শুরু করেছে। যখন কোন সংকেত -এর খবর শোনা যায়,তখন স্থানীয় ও উপজেলা প্রশাসনের নজর থাকে গোলাখালী উপর, কারণ তাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ব্যাপক খারাপ।গোলাখালী পাঁচটি নদী ও সুন্দরবন দ্বারা বেষ্টিত। এখানে সুপেয় পানি বলতে লবণ পানি ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে মানুষের জীবন -জীবিকা নির্বাহ করতে হয়।বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল এলাকায় যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেই দক্ষিণ -পশ্চিম অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লোনা এবং ব্যবহারের উপযোগী নয়। নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা এই গ্রামগুলি বিগত কয়েক দশক ধরে মানুষ বসবাস করে আসছে। যেখানে মহাজনদের চিংড়ি চাষ শ্রমজীবী মানুষের সুন্দরবন নির্ভরশীলতায় এখানকার পেশা হিসেবে দাঁড়িয়েছে।সুপেয় পানি সংকট এই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের অভিশাপ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও লবণ পানির চিংড়ি চাষের করাল গ্রাসে গোলাখালী গ্রাম লবণ পানিতে ভরে যায়। সমুদ্রে উপকূলবর্তী হওয়ার কারণে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই থাকে। এখানে কৃষিকাজ থেকে মানুষের পেশা পরিবর্তন করে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ করা,সুন্দরবনের মাছ কাকড়া সংগ্রহ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করে। এক সময় বেঁচে থাকার তাগিদে গোলাখালী বাসীর সুপেয় পানি সংগ্রহ করার জন্য গ্রাম ছেড়ে ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে নৌকা যোগে পানি সংগ্রহ করতে হতো। এই অবস্থায় আইলা পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মহাজন চিংড়ি চাষীদের উদ্যোগে তিনটি অংশে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছে। বলে রাখা দরকার নিত্য দিনের খাদ্য সামগ্রীদের মধ্যে সুপেয় পানি পরিবারের একটি বড় অংশের চাহিদা পুরণ করতে গোলাখালী বাসীর হিমশিম খেতে হয়। পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের বেঁচে থাকা বা জীবন যাপনের জন্য সুপেয় বা নিরাপদ পানি প্রয়োজন। যদিও প্রাকৃতিক ভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি লোনা এই এলাকাটি জনবসতি হিসেবে ৮৭ টি পরিবার একসময়ে বসতি স্থাপন করেছিল। গোলাখালীতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা মিষ্টি পানি সংরক্ষণের জন্য হাজা- মজা, ডোবা নালা, এখানে একেবারেই নেই। উপকূলের এলাকাতেই লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে পানি সংকট তৈরি হয়েছে। অতীতে উপকূল এলাকায় গোলাখালী মানুষেরা দূর থেকে পুকুরের পানি সংরক্ষণ করলেও সেখানে অনেক বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা এবং পানি বাহিত রোগ থেকে মুক্তি মেলেনি। ২০০৯ সালে আইলার পরবর্তী সময়ে স্থানীয় চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ী আব্দুল গফুরের সদায় দৃষ্টিতে এলাকার মানুষের জন্য একটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল। সেই টিউবয়েলের পানি দেখলে মনে হয় ডিজেল কিংবা পেট্রোলের মতো।
কিন্তু স্থানীয়রা জানান নিরুপায় হয়ে এই পানি ব্যবহার করছেন। এই পানি ব্যবহার করে তারা ভালই আছেন। এই পানিতে কোন গ্যাস হয়না কোন প্রকার খাবার সমস্যা হয় না। প্রথম দিকে পানির রং দেখে অনেকেই ব্যবহার বা খেতে চাইতেন না পরবর্তী সময়ে এই পানি ব্যবহার করে এলাকার মানুষ ভালো আছেন। দীর্ঘ ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় সৌরভী রানী বলেন আমরা এই জল খেয়ে ভালো আছি, কোন গ্যাস হয় না পেটের রোগ হয় না। এক সময় আমাদের হিন্দু পাড়ার লোকজন দূর থেকে জল নিয়ে আসা লজ্জা পেতো। আমরা এখানে অনেক হিন্দু পরিবার একসাথে বসবাস করতাম এখন মাত্র পাঁচঘর বসবাস করি। সুন্দরবনের সাথে আমাগো বাড়ি, আমাদের ঘেরের মাথায় সুন্দরবন। আইলার পর একবার বাঘ এসেছিল ছাগল খেয়ে আবার চলে যায়। আমাগো এখানে সবাই সুন্দরবনের বাঘ দেখেছি।
আমরা এখানে বসবাস করছি, ঝড় আসে নদী ভাঙ্গে, জল ওঠে তার মধ্যে আমরা ভালো আছি। আর খাবার জলের কথা শুনলে বলেন আগে আমাদের এখানে কোন খাবার জলের উপায় ছিল না। আমরা নদী পার হয়ে ওপার থেকে জল এনে খেতাম। তারপর দুটো টিউবওয়েল হওয়ার পরে আমাদের খাওয়ার জলের কষ্ট কমে গেছে। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা গোলাখালীর উজ্জল মণ্ডল বলেন আমাদের এখানে ২০০৭ সালের পূর্বে প্রচুর পানির কষ্ট ছিল। কৈখালী ফরেস্ট অফিস দিঘি থেকে পানি এনে খেতে হতো, কালিঞ্চে গফর মেম্বারের দিঘী ও ভেটখালী বাজার থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়েছে।
আইয়লার পূর্বে থেকে গোলাখালী সময়ে বিভিন্ন এলাকার পুকুরের পানি খেয়ে আমাদের পেটের পীড়া , পানি বাহিত সকল রোগ লেগেই থাকত, বর্তমানে সেটা আর নেই বললেই চলে । ২০০৭ সালে প্রিয়তোষ বিশ্বাসের উদ্যোগে গোলাখালী পূর্বপাড়ায় স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারদের সহযোগিতায় প্রথম ডিপ টিউবওয়েল এল স্থাপন হয়েছে। এরপর মধ্যপাড়ায় মিজানুর রহমানের সহযোগিতায় আরেকটি ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়।
শ্যামনগর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিতি থেকে স্থাপন করেন। দ্বীপ গোলাখালি গ্রামে ডিপ টিউবওয়েল স্থাপনের পরে, এলাকার মানুষের পানি দুর্ভোগ কমে গেছে। এলাকার মানুষের এই পানি ব্যবহার করে কোন ক্ষতি হচ্ছে না বলে জানান উজ্জ্বল মন্ডল। স্থানীয়রা আরো বলেন গোলাখালীর বসতি দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, এখানে আগে যে বসতি ছিল বর্তমানের ৮৭ টি পরিবার আছে। এখানে যাতায়াত ব্যবস্থা, শিক্ষার, চিকিৎসা স্বাস্থ্য, সবকিছুতেইগুলা গোলাখালি দ্বীপের মানুষ বঞ্চিত হয় । এখানে অল্প কিছু সংখ্যক ভোটার থাকার কারণে ওপারের কালিঞ্চে গ্রামের সাথে গোলাখালি গ্রাম যুক্ত করে রাখা হয়েছে। এমনকি গোলাখালি নামের প্রাথমিক বিদ্যালয়টি কালিঞ্চ গ্রামে স্থাপন করা হয়েছে। গোলাখালির উত্তর পাড়ার ১৭ টি পরিবার জোয়ার ভাটার মধ্যে বসবাস করছে ।
তারপরও এই দ্বীপ ছেড়ে মানুষ বাইরে যেতে চাইছে না। এলাকাবাসী আরো বলেন আমরা এখানে জন্মগ্রহণ করে বেড়ে উঠেছি আমরা এখানেই থাকতে চাই।
তবে তাদের দাবী:
১. উপকুলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে অন্য অন্য এলাকার তুলনায় বেশি সহযোগিতা করা।
২. গোলাখালি বনের পাড়ে বনবিবি মন্দির থেকে পূর্ব দিকে সুন্দরবনের পাশ দিয়ে তারের বেড়া দিয়ে জনবসতি নিরাপদ রাখা।
৩. তিনটি পাড়ার মধ্যে নিরাপদ সংযোগ যাতায়াত রাস্তার ব্যবস্থা করা।
৪. দ্বীপ গ্রাম গোলাখালীর চারিপাশের বাঁধ গুলি পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় নিয়ে আসা।
৫. দুর্যোগ সহনশীল স্থায়ী আবাসন প্রকল্প নির্মান করা ।
Leave a Reply